আজ শনিবার সন্ধ্যা ৬:৪৮, ২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৬শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি
২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ এবং বন্ধের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের এক গোপন অথচ গুরুত্বপূর্ণ দিক। আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন, নির্বাচন, ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে মানুষের যোগাযোগের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করেছে। এমনকি এসব পরিস্থিতির মাধ্যমে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে জনমানসে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।
২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া প্রতিবাদ এবং সহিংসতার সময় সরকার ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়, যার ফলে অনেক মানুষ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেননি। এ ধরনের ঘটনাগুলি একের পর এক ঘটতে থাকে, যার মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর দমনপীড়ন চালানো সহজ হয়ে উঠেছিল।
প্রতিবছর অন্তত একাধিক বার দেশের বিভিন্ন স্থানীয় আন্দোলন, নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের সময় সরকার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ২১ বার ইন্টারনেট বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী ইন্টারনেট শাটডাউন। ওই সময় ৩জি ও ৪জি সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়, যাতে বিরোধীদের ভোট কারচুপি ও অনিয়মের প্রতিবেদন সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের সময় সরকার সারা দেশে মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০২2 সালের নভেম্বরেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়।
এছাড়া ২০১৮ সাল, ২০২০, ২০২৩ সালের বিভিন্ন বিক্ষোভের সময় সরকার ইন্টারনেট গতি কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যা প্রমাণ করে যে সরকারের কাছে ইন্টারনেট আর কোনো আধুনিক প্রযুক্তি বা সেবা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০২৪ সালের মধ্যে, ইন্টারনেট বন্ধের এই প্রবণতা আরো তীব্র হয়, যখন বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি আক্রমণ বাড়ে এবং ইন্টারনেট বন্ধের মাধ্যমে সারা বিশ্বের কাছে ঘটনাগুলি পৌঁছাতে বাধা দেয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর সময় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় জনগণকে সংকটের সময়ে তথ্যের অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইন্টারনেট বন্ধের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, যেটি শুধু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোই নয়, দেশের পুরো ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জরুরি সেবা কার্যক্রমের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
এত কিছুর পরও ইন্টারনেট বন্ধের এই অভ্যাসের বিরোধিতা করতে মাঠে নেমেছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন এক্সেস নাও, যারা দাবি করে আসছে যে, ইন্টারনেট সেবা এখন আর কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এরই মধ্যে বাংলাদেশে স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতে সরকারের ইন্টারনেট বন্ধের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী অনেকেই।
বাংলাদেশের বর্তমান ইন্টারনেট বন্ধের সংস্কৃতি, যা সরকারের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে দেশের সাধারণ মানুষ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যা গণতন্ত্রের জন্য এক বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।