আজ সোমবার ভোর ৫:১৩, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

বিপিএল ঠিক হতে পারে যেভাবে

নিউজ ডেস্ক |দুরন্ত নিউজ .কম
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫ , ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ
ক্যাটাগরি : খেলা

বিপিএল বললেই চলে আসে ‘বিতর্ক’। গত ১১টি বিপিএলে শব্দটা এতবার এসেছে যে এখন এসব নিয়ে কথা বলতেও ক্লান্তি লাগে। এই একটি টুর্নামেন্ট যেন ক্রিকেট খেলাটাকেই প্রতিবার কেটে-ছিঁড়ে ফালি ফালি করে দেয়।

সদ্য সমাপ্ত একাদশ বিপিএলও ব্যতিক্রম নয়, তবে ব্যতিক্রম এবারের কিছু ইতিবাচক দিক। টুর্নামেন্টে ১২ কোটি টাকার ওপরে টিকিট বিক্রি হয়েছে, যা চোখ বুজে রেকর্ড। এই প্রথম টিকিট বিক্রির টাকার ভাগ পাবে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। খেলা দেখে না থাকলেও টাকার অঙ্ক শুনে বুঝে যাওয়ার কথা, বিপিএলে গ্যালারি ছিল ভরপুর। রানপ্রসবা উইকেটে মাঠের ক্রিকেটও এবারই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো হয়েছে।

কিন্তু ওই যে বিতর্কগুলো, বিপিএলের যা কিছু ভালো, সবকিছুকেই যে তা আড়াল করে দেয়! তবে শুধু বিতর্ক আর নয়। আসুন এবার একটু খুঁজে দেখা যাক, কী করলে বিপিএল বিতর্কমুক্ত হতে পারে। বাংলাদশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট ক্রিকেট–বিশ্বে কীভাবে ভালো একটা টুর্নামেন্টের মর্যাদা পেতে পারে। একাদশ বিপিএলের সব ম্যাচ দেখে এবং আগের আসরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে এখানে সে রকমই কিছু উপায় খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে—

বিসিবির পরিকল্পনা আছে, আগামী বছর নতুন চক্র থেকে টুর্নামেন্ট আয়োজনের স্বত্ব কোনো স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির হাতে দীর্ঘ মেয়াদে তুলে দেওয়ার। যদিও ২০১২ সালে বিপিএল শুরু হয়েছিল এ রকমই একটি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে, বিতর্কের শুরুও তখন থেকেই। অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না বলে বিসিবি পরে নিজেরাই টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে শুরু করে।

এখন আবার সে পথে ফিরে যেতে হলে অবশ্যই বড় এবং নামী কোনো প্রতিষ্ঠানকে আয়োজনের স্বত্ব দিতে হবে। বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ বলেছেন, দরপত্রের মাধ্যমে সে রকম সেরা প্রতিষ্ঠানই তাঁরা বেছে নেবেন, যাদের এ ধরনের টুর্নামেন্ট আয়োজনে বিশ্বে সুনাম আছে।

সঙ্গে নিশ্চয়ই বিসিবি এটাও নিশ্চিত করবে যে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বিপিএলে স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে না। তাদের নিজেদের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি থাকবে না। তারা খেলোয়াড় আনার এজেন্ট হবে না। ক্রিকেট জুয়ার কারবারে তাদের সংশ্রব থাকবে না। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, টুর্নামেন্ট আয়োজন ছাড়া অন্য যেকোনো কিছুর সঙ্গেই আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা বিপিএলে বিতর্কের বিপদ ডেকে আনতে পারে।

গত ১১টি বিপিএলেই বড় বিতর্কগুলো হয়েছে মূলত কোনো না কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ঘিরে। ঝামেলা বাধিয়েছে কখনো দুর্বল ফ্র্যাঞ্চাইজি, কখনোবা অতি শক্তিশালী ফ্র্যাঞ্চাইজি। রাক্ষুসে ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্ষমতার দাপট এবং দুর্বল ফ্র্যাঞ্চাইজির অভাবের সংসার—বিপিএলের মতো দৃষ্টি আকর্ষক টুর্নামেন্টে কোনোটিই কাম্য নয়।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান যেন বিসিবির বেঁধে দেওয়া সব শর্ত পূরণ করতে পারা ফ্র্যাঞ্চাইজিদেরই নির্বাচন করে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিটাও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। এ জায়গায় ছাড় মানেই দেড়-দুই মাসের টুর্নামেন্টে পদে পদে হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা। গত ১১টি বিপিএল থেকে এ শিক্ষাই সবার আগে নেওয়া উচিত বিসিবির—‘না’ বলতে হবে সম্ভাব্য দুর্বল ও রাক্ষুসে ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রতিষ্ঠানকে।

দুর্বল ফ্র্যাঞ্চাইজি মানেই ক্রিকেটারদের পাওনা ঠিকভাবে না দেওয়া এবং সেটার জেরে আরও অনেক বিতর্কের শঙ্কা। অন্যদিকে অতি ক্ষমতাশালী ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রভাবে বিপিএলের মাঝপথে বাইলজ বদলের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি নির্দিষ্ট একটি ম্যাচের উইকেট বানানো হয়েছে ক্ষমতাবান ফ্র্যাঞ্চাইজির বোলিং আক্রমণের মুখে হাসি ফোটাতে, আগের টুর্নামেন্টগুলো ঘাঁটলে এমন উদাহরণও পেয়ে যাবেন।

প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক ভাবমূর্তি, আর্থিক সচ্ছলতা, বিশেষ করে স্থানীয় ও বিদেশি খেলোয়াড়দের মোট পারিশ্রমিকের অন্তত ২৫ শতাংশ ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়ার সামর্থ্য থাকাটাকে ফ্র্যাঞ্চাইজি নির্বাচনে প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিসিবি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও। কারণ, খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক দেওয়া নিয়ে গোলটা বাধে মূলত বিসিবি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর কাছ থেকে ব্যাংক গ্যারান্টি নিতে পারে না বলেই। বিসিবিকেই তখন দেনা-পাওনা মেটানোর দায়িত্ব নিতে হয়।

দেশে-বিদেশে বিপিএলকে তুলে ধরে মূলত এই ফ্র্যাঞ্চাইজিরাই। বলতে পারেন, তারাই টুর্নামেন্টের আয়না। তারকা ক্রিকেটার এনে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোই পারে টুর্নামেন্টটাকে আলোকিত করতে, আবার কম বাজেটে অখ্যাত ক্রিকেটারদের এনে তারা এর জৌলুশ কমিয়েও দিতে পারে। কাজেই ফ্র্যাঞ্চাইজির ঔজ্জ্বল্য থাকলে উজ্জ্বল হবে বিপিএলও। ভালো ফ্র্যাঞ্চাইজি না পেলে প্রয়োজনে কম ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়েই হোক টুর্নামেন্ট।

২০১২ সালে যখন বিপিএল প্রথম শুরু হয়, তার আগে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট বলতে শুধু আইপিএলই ছিল। এখন তো দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। বিপিএলের জন্য ফাঁকা সময় খুঁজে পাওয়াটাই কঠিন। এবার যেমন প্রায় একই সময়ে দুবাইয়ে আইএল টি-টোয়েন্টি ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এসএ টোয়েন্টি হওয়ায় বিদেশি ক্রিকেটাররা সব সেদিকে ঝুঁকে গেছেন।

এবারের বিপিএলে বারবারই আলোচনাটা এসেছে। চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশালের অধিনায়ক তামিম ইকবাল কয়েকবারই বলেছেন, টুর্নামেন্টের জন্য উপযুক্ত ‘উইন্ডো’ খুঁজে বের করা দরকার, যখন তারকা ক্রিকেটারদের পাওয়া যাবে। বিসিবিরও পরিকল্পনা আছে আগামীবার থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টুর্নামেন্ট শুরু করার।

বিসিবি সব সময় বলে, ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়। কিন্তু কাজে সেই শক্ত অবস্থানের ছাপ নেই। বিসিবির নিজস্ব দুর্নীতি দমন বিভাগ নামসর্বস্ব, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার। কাজের চেয়ে তাদের কথাই শোনা যায় বেশি, যেসব কথা মাঝেমধ্যে বিতর্কও সৃষ্টি করে।

অথচ অর্থ সাশ্রয়ের কথা বলে বিসিবি আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের কাছ থেকেও এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো সহযোগিতা নিচ্ছে না। বর্তমান বাস্তবতায় এসব টুর্নামেন্টে ফিক্সিং-স্পট ফিক্সিং বন্ধ করা কঠিন। কিন্তু বন্ধের জন্য যথাযথ উদ্যোগ তো থাকতে হবে, যাতে সবাই অন্তত বিসিবির চেষ্টাটা দেখতে পায়।

বিতর্ক এড়ানোর অজুহাতে এসব ঘটনা ঢেকে না রেখে প্রকাশ করে দিলেই বরং সবাই এই ভেবে আস্থা পাবে যে বিপিএলে অন্তত নজরদারিটা আছে। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ বিসিবি বা আয়োজকদের স্বচ্ছ মানসিকতার পরিচয়ও দেবে।