আজ সোমবার সকাল ৯:২৮, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি
কক্সবাজার শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়ন। একসময় বরইতলীর বিভিন্ন গ্রামে বরই চাষ হতো। তবে এখন হচ্ছে গোলাপের চাষ। এ কারণে ইউনিয়নটি পরিচিত হয়ে উঠেছে গোলাপ গ্রাম নামে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে মহাসড়কের ওপর দিয়ে যেতে অতিক্রম করতে হয় চকরিয়ার এই বরইতলী এলাকা। মহাসড়কের কয়েক কিলোমিটার অংশে দুপাশে চোখে পড়ে লাল গোলাপের বাগান। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা গোলাপের ঘ্রাণ মোহিত করে সড়কের যাত্রীদেরও।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মহাসড়কের দুপাশে বিভিন্ন বাগানজুড়ে ফুটে আছে লাল গোলাপ। দূর থেকে দেখে মনে হয়, কেউ যেন সবুজের ওপর লালগালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বেলা ১১টার দিকে সড়কের পূর্বপাশের একটি বাগানে ঢুকে দেখা যায়, সাতজন শ্রমিক বাগান থেকে গোলাপ কাটছেন। দূরে দাঁড়িয়ে গোলাপ কাটার কাজ তদারক করছেন বাগানের মালিক ইদ্রিস আহমদ।
রিপন দে (৪০) নামে বাগানের এক শ্রমিক বলেন, সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ৮ শতাধিক গোলাপ কেটেছেন (সংগ্রহ) তিনি। রিপন জানান, প্রতিদিন সকালের দিকে গোলাপ কাটেন তিনি। তারপর সেই গোলাপ গাড়িতে করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম। বাগানের নারী শ্রমিক শিল্পী রানি দে (৫৫) বলেন, তিন ঘণ্টায় তিনি সাত শতাধিক গোলাপ কেটেছেন। ১০ বছর ধরে তিনি বাগানে গোলাপ কাটছেন।
বাগানের মালিক ইদ্রিস আহমদের (৬০) সঙ্গেও কথা হয়। তিনি বলেন, ২৩ বছর ধরে তিনি গোলাপ চাষ করে আসছেন। প্রতিবছর তিনি ৫০ লাখের বেশি গোলাপ বিক্রি করেন। আয় করেন ২৫ লাখ টাকার বেশি। অনেক সময় গোলাপ বিক্রি হয় না, গাছেই নষ্ট হয়। তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। এ ধরনের সময়ে ফুল বিনা মূল্যে বিতরণের জন্যও কাউকে পাওয়া যায় না।
বাগানটির মালিক ও শ্রমিকেরা জানান, ৬ কানির (কানিতে ৪০ শতক) বাগানটিতে গাছ আছে ২৪ হাজার। প্রতিটি গাছে ফুটেছে দুই থেকে পাঁচটি গোলাপ। প্রতিদিন ৬ হাজার গাছ থেকে প্রায় ৩০ হাজার গোলাপ কাটা হয়। তারপর সেই ফুল পাঠানো হয় চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকার ফুলের দোকানগুলোয়। প্রতিটি গোলাপ সাধারণত পাইকারিতে বিক্রি হয় দেড় টাকায়। ইদ্রিস আহমদ বলেন, গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি করেছেন ১০ টাকা দরে। এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হতে পারে। ওই দিন তিনি ৬০ হাজার গোলাপ বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইদ্রিস আহমদের দক্ষিণ পাশে আবদুল মান্নানের তিন কানির আরেকটি গোলাপবাগান। এই বাগানের প্রতিটি গাছে ফুটেছে তিন থেকে চারটি লাল গোলাপ। সকালের কয়েক ঘণ্টায় গাছগুলো থেকে কাটা হয় দেড় হাজারের বেশি গোলাপ। এই ফুলও চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকায় সরবরাহ করা হবে জানিয়ে আবদুল মান্নান (৫৫) বলেন, একসময় বাগানের এ জমিতে তামাকের চাষ হতো। লাভজনক তামাক চাষ বাদ দিয়ে তিনিসহ গ্রামের ৪০ জন চাষি ৬০ কানি জমিতে ছোট-বড় ১৫টি গোলাপবাগান সৃজন করেন। প্রথম দিকে চাষিরা লাভবান হলেও এখন ফুলের বাজার মন্দা।
একই এলাকায় তিন কানি জমিতে গোলাপবাগান করছেন চাষি মোহাম্মদ এনাম। তাঁর পাশে দিদার আলমের এক কানির একটি এবং বদিউল আলমের এক কানির একটি বাগানেও গোলাপ কাটা হচ্ছে। বাগানের চাষিরা প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে গোলাপ বিক্রির জন্য ভালোবাসা দিবসের অপেক্ষায় রয়েছেন।
বরইতলীর লামার পাড়ায় ৪০ শতাংশ জমিতে গোলাপবাগান করেছেন স্থানীয় চাষি নাছির উদ্দিন। তাঁর বাগানে গাছ আছে ৪ হাজার ২০০টি। নাছির উদ্দিন জানান, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের দিনে তিনি বাগান থেকে কাটবেন প্রায় দুই হাজার গোলাপ। তখন গোলাপের দাম ১০ থেকে ১২ টাকা পাওয়া যেতে পারে।
চাষিরা জানান, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন ও ১৬ ডিসেম্বরে গোলাপের প্রচুর চাহিদা দেখা দেয়। ওই সময় প্রতিটি গোলাপ ৮ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বরইতলী ইউনিয়নের উপর পাড়া, নামার পাড়া, খয়রাতি পাড়া, নতুন রাস্তার মাথা, মাইজ পাড়াসহ ১০ থেকে ১২টি গ্রামে গোলাপের চাষ হয়েছে। লাল গোলাপে রঙিন সব কটি বাগান।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে বরইতলী ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ গোলাপ বিক্রির উদ্দেশ্যে কাটা হয়। এর ৯০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় এলাকার ফুলের দোকানগুলোয়। অবশিষ্ট গোলাপ চকরিয়া ও কক্সবাজারের বিভিন্ন দোকান সরবরাহ করা হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বরইতলীর ১০৫ একর জমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে। বাগান আছে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৩টি। বর্তমানে এসব বাগানে ১৩ লাখের মতো গোলাপ ফুটেছে। এর মধ্যে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের এক দিনেই কাটা হবে অন্তত চার লাখ গোলাপ। তিনি আরও বলেন, বিশেষ দিবসে গোলাপের ভালো দাম পাওয়া গেলেও অন্য দিনগুলোয় দাম তেমন পাওয়া যায় না। অনেকটা পানির দরেই গোলাপ বেচাবিক্রি করতে হয় চাষিদের। এর অন্যতম কারণ কাগজের ফুলের বেচাবিক্রি।
বরইতলী গোলাপ বাগান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম বলেন, গোলাপের বাজার কয়েক বছর ধরে দখলে রেখেছে কাগজ ও প্লাস্টিকের ফুল। এতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কাগজ ও প্লাস্টিকের ফুল দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। তাই বিয়েশাদি, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলের মঞ্চ সাজানো থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানেই এখন কাগজ ও প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার করা হয়। তিনি আরও বলেন, পরিপক্ব গোলাপ এক দিনের বেশি রাখা যায় না, গাছেই নষ্ট হয়ে যায়। এলাকায় গোলাপ সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।